বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারানো মানুষের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বয়স্ক ভাতা। এটি মূলত একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, যা প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা করে। বর্তমানে বয়স্ক ভাতা শুধুমাত্র অনলাইনে আবেদন করা সম্ভব এবং এটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপকারভোগীদের নিকট মাসিক ভিত্তিতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
এই প্রবন্ধে, আমরা বয়স্ক ভাতার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া, আবেদন পদ্ধতি, উপকারভোগীর যোগ্যতা, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
বয়স্ক ভাতা কী?
বয়স্ক ভাতা হলো সরকারের একটি সামাজিক নিরাপত্তা প্রোগ্রাম, যা ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে (নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ বছর) প্রবীণদের জন্য প্রযোজ্য। এই প্রোগ্রামের আওতায়, প্রবীণ ব্যক্তিদের মাসিক ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন চাহিদা পূরণে সহায়ক। বর্তমানে মাসিক ভাতার পরিমাণ ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বছরে ৭২০০ টাকা। সরকারের উদ্যোগে এই ভাতা প্রোগ্রাম ধীরে ধীরে আরও উন্নত করা হচ্ছে। বয়স্ক ভাতার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং তাদের দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য একটি ন্যূনতম আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সরকারি এই উদ্যোগ বয়স্কদের প্রতি পরিবারের নির্ভরশীলতা কমিয়ে, তাদের স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে সহায়তা করে।
বয়স্ক ভাতার যোগ্যতা
সরকারের এই ভাতা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা পূরণ করতে হয়। যোগ্যতার মানদণ্ড নিম্নরূপ:
- বয়স: পুরুষদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৬৫ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৬২ বছর হতে হবে। বয়সের এই সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যানুসারে।
- বাসিন্দার প্রমাণ: প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। এজন্য আবেদনকারীর জন্ম নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা আবশ্যক।
- আর্থিক অবস্থা: প্রার্থীর বার্ষিক গড় আয় সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা হতে হবে। এর চেয়ে বেশি আয় হলে তিনি এই ভাতার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।
- নির্বাচিত হওয়া: আবেদনকারীর তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে স্থানীয় বাছাই কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত হতে হবে।
- অন্যান্য প্রাপ্ত ভাতা: প্রার্থী যদি অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা প্রোগ্রামে নিবন্ধিত থাকেন তবে তিনি বয়স্ক ভাতা পাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।
বয়স্ক ভাতা আবেদন | বয়স্ক ভাতা অনলাইন আবেদন
বয়স্ক ভাতার আবেদন প্রক্রিয়া বেশ সহজ এবং সরাসরি। এখন শুধুমাত্র অনলাইনেই এই ভাতার জন্য আবেদন করা সম্ভব। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশে এখন ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করা যাচ্ছে। আবেদন প্রক্রিয়াটি সহজ এবং যে কেউ অনলাইনে এ আবেদন সম্পন্ন করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন:
- আবেদন ফরম পূরণ: নির্ধারিত ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে। আবেদনের লিংক হলো mis.bhata.gov.bd/onlineApplication আবেদনকারীকে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে।।
- প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণপত্র সংযুক্তকরণ: আবেদন ফরম পূরণের পর ইউপি সদস্য, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং অন্যান্য কাগজপত্র স্ক্যান করে আপলোড করতে হবে।
- মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট: ভাতা প্রাপ্তির জন্য আবেদনকারীর সক্রিয় নগদ বা বিকাশ অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। যে অ্যাকাউন্টে ভাতা প্রদান করা হবে, সেই নম্বর আবেদন ফরমে দিতে হবে।
- প্রয়োজনীয় যাচাইকরণ ও এন্ট্রি: জমাকৃত আবেদনসমূহ সমাজসেবা অধিদপ্তর যাচাই করে প্রয়োজনীয় তথ্য নিশ্চিত করবে। এরপর উপকারভোগীদের তালিকা প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। এই তথ্য যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হওয়ার পর মাসিক ভাতা নগদ বা বিকাশের মাধ্যমে সরাসরি আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরে চলে আসবে।
- ভাতা প্রদান প্রক্রিয়া: যাচাই-বাছাই শেষে নির্বাচিত ব্যক্তিরা প্রতি মাসে সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং (নগদ/বিকাশ) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৬০০ টাকা হারে ভাতা পেয়ে থাকেন।
আবেদন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
অনলাইনে বয়স্ক ভাতা প্রাপ্তির আবেদন করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেটের ফটোকপি।
- ইউপি সদস্য, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, পৌরসভার কাউন্সিলর বা সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র।
- আবেদনকারীর সক্রিয় মোবাইল নম্বর (নগদ বা বিকাশের জন্য)।
এই সমস্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এগুলো ছাড়া আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না।
বয়স্ক ভাতা প্রাপ্তির আবেদন সময়সীমা
নতুন আবেদনকারীদের জন্য প্রতিটি বছর নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে ১০ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করা হয়। এই সময়সীমার মধ্যে যারা অনলাইনে আবেদন করেন, তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করা হয়।
যারা পূর্বে বয়স্ক ভাতা পেয়েছেন, তাদের পুনরায় আবেদন করার প্রয়োজন নেই। নতুনদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করা হবে এবং পূর্বে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের আবেদন পুনরায় গৃহীত হবে না।
মৃত ভাতাভোগীর অর্থ উত্তোলন প্রক্রিয়া
যদি কোনো বয়স্ক ভাতাভোগী মৃত্যুবরণ করেন, তবে তার নমিনি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ব্যাংক থেকে তার প্রাপ্য অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। এর প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপ:
- মৃত্যুসনদ সংগ্রহ: মৃত্যুর ৭ দিনের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করতে হবে।
- ভাতাবহি জমা: ভাতাভোগীর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তার ভাতাবহিটি সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা অফিসে জমা দিতে হবে।
- প্রাপ্য অর্থ উত্তোলন: মৃত ভাতাভোগীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত অর্থ এবং অতিরিক্ত মৃত্যুমাসসহ পরবর্তী দুই মাসের ভাতা নমিনি উত্তোলন করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি জানুয়ারি মাসে ভাতাভোগী মৃত্যুবরণ করেন, তবে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মোট অর্থ নমিনি তুলতে পারবেন।
নমিনির মোট প্রাপ্য অর্থ হচ্ছে মৃত ভাতাভোগীর একাউন্টে পূর্বে জমাকৃত টাকা এবং মৃত্যুমাসসহ পরবর্তী দুই মাসের ভাতা।
বিশেষ দিকনির্দেশনা ও সতর্কতাসমূহ
১. অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা প্রাপ্তদের জন্য নিষেধাজ্ঞাঃ যদি কোনো ব্যক্তি ইতোমধ্যে অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা বা ভাতা প্রোগ্রামে নিবন্ধিত থাকেন, তবে তিনি বয়স্ক ভাতার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। অর্থাৎ, একই ব্যক্তিকে একাধিক ভাতার আওতায় আনা হবে না।
২. পেনশনভোগী সরকারি কর্মচারীদের জন্য নিষেধাজ্ঞাঃ যেসব বয়স্ক ব্যক্তি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে নিয়মিত পেনশন পেয়ে থাকেন, তারা বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করতে পারবেন না। কারণ, পেনশনভোগীরা সরকারের থেকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা পান।
বয়স্ক ভাতা প্রোগ্রামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বয়স্ক ভাতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এই ভাতা কেবল প্রবীণদের আর্থিক সুরক্ষাই দেয় না বরং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে আরও শক্তিশালী করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ, সেখানে এই ভাতা প্রোগ্রাম প্রবীণদের জন্য অন্ততপক্ষে একটি আর্থিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়।
শেষ কথা
বয়স্ক ভাতা প্রোগ্রামটি বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা উদ্যোগ। এটির মাধ্যমে সরকার প্রবীণদের আর্থিক সুরক্ষার পাশাপাশি তাদের জীবনের মান উন্নত করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাতা প্রদানের সুবিধা আরও সহজ করা হয়েছে, যা সবার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই প্রোগ্রামের সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আশা করা যায় যে, আগামীতে এই ভাতার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং প্রোগ্রামটি আরও অনেক বয়স্ক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাবে।