মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ কত

মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ কত

মানুষের শরীরের রক্তের পরিমাণ তার আকার, ওজন এবং লিঙ্গের উপর নির্ভর করে। রক্ত আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা অক্সিজেন, পুষ্টি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান সারা শরীরে বন্টন করে এবং বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে। রক্তের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষ, টিস্যু এবং অঙ্গের সুস্থতা নিশ্চিত হয়। এই নিবন্ধে, আমরা মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ, এর কার্যকারিতা এবং বিভিন্ন প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

রক্ত কাকে বলে

রক্ত হলো একটি জটিল ও বহুমুখী শারীরবৃত্তীয় উপাদান, যা আমাদের দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মূলত তরল এবং কণিকামূলক উপাদান দিয়ে গঠিত, যা দেহের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পাদন করে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। রক্তের প্রাথমিক কাজগুলোর মধ্যে অক্সিজেন পরিবহন, পুষ্টি সরবরাহ, বর্জ্য পদার্থ অপসারণ, এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখা অন্তর্ভুক্ত।

রক্তের পরিমাণ নির্ধারণের ভিত্তি

মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ সাধারণত তাদের ওজনের উপর নির্ভর করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে মোট ওজনের ৭% থেকে ৮% রক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তির ওজন হয় ৭০ কেজি, তবে তার শরীরে প্রায় ৪.৯ থেকে ৫.৬ লিটার রক্ত থাকবে। এই পরিমাণ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে, যা ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা, বয়স, লিঙ্গ, এবং অন্যান্য ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল।

রক্তের উপাদান

রক্ত একটি জটিল তরল পদার্থ, যা মূলত দুইটি অংশে বিভক্ত: প্লাজমা এবং কোষীয় উপাদান।

  1. প্লাজমা: রক্তের প্রায় ৫৫% হলো প্লাজমা, যা মূলত পানি, ইলেক্ট্রোলাইটস, প্রোটিন, হরমোন, এবং বর্জ্য পদার্থ নিয়ে গঠিত। প্লাজমা শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং এটি রক্তের কোষগুলি পরিবহন করতে সহায়তা করে।
  2. কোষীয় উপাদান: বাকি ৪৫% হলো বিভিন্ন ধরনের রক্তকোষ, যেমন লোহিত রক্তকণিকা (ইরিথ্রোসাইট), শ্বেত রক্তকণিকা (লিউকোসাইট), এবং প্লাটিলেটস (থ্রম্বোসাইট)।
    • লোহিত রক্তকণিকা (ইরিথ্রোসাইট): এগুলি হিমোগ্লোবিন নামে একটি প্রোটিন বহন করে, যা শরীরে অক্সিজেন পরিবহন করে।
    • শ্বেত রক্তকণিকা (লিউকোসাইট): এগুলি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে এবং জীবাণু বা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করে।
    • প্লাটিলেটস (থ্রম্বোসাইট): এগুলি রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, যা রক্তপাত বন্ধ করতে সহায়তা করে।

রক্তের পরিমাণের তারতম্যের কারণ

একজন ব্যক্তির শরীরে রক্তের পরিমাণ বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো:

  • লিঙ্গ: পুরুষদের শরীরে সাধারণত মহিলাদের তুলনায় বেশি রক্ত থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে গড়ে ৫ থেকে ৬ লিটার রক্ত থাকতে পারে, যেখানে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ প্রায় ৪ থেকে ৫ লিটার।
  • শারীরিক সক্রিয়তা: যারা শারীরিকভাবে বেশ সক্রিয় এবং নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের শরীরে রক্তের পরিমাণ কিছুটা বেশি হতে পারে।
  • উচ্চতা ও ওজন: লম্বা এবং ভারী শরীরের মানুষদের শরীরে রক্তের পরিমাণ বেশি থাকে।
  • অস্বাভাবিক অবস্থায়: কোনো ধরনের অসুস্থতা, ডিহাইড্রেশন, বা রক্তপাতের কারণে রক্তের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।

রক্তের ভূমিকা ও কার্যকারিতা

রক্ত আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য এক উপাদান। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নিচে দেওয়া হলো:

  1. অক্সিজেন এবং পুষ্টি পরিবহন: রক্তের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছে দেওয়া হয়।
  2. বর্জ্য অপসারণ: রক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অন্যান্য বিপাকীয় বর্জ্যকে শরীর থেকে অপসারণ করতে সহায়ক।
  3. হরমোন পরিবহন: রক্ত হরমোন পরিবহন করে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।
  4. রোগ প্রতিরোধ: শ্বেত রক্তকণিকার মাধ্যমে রক্ত আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে এবং বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
  5. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: রক্ত শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, যা আমাদের শরীরের সুস্থতা রক্ষায় অপরিহার্য।

রক্তের পরিমাণ কম হলে করণীয়

যদি শরীরে রক্তের পরিমাণ কমে যায়, তবে তা শারীরিক সুস্থতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নিম্নরক্তচাপ, অ্যানিমিয়া, ক্লান্তি, মাথা ঘোরা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় নিচের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  • পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ: আয়রন, ভিটামিন বি১২, এবং ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। এসব পুষ্টি রক্তের হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধিতে সহায়ক।
  • ডাক্তারের পরামর্শ: যদি কোনো ধরনের রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পানি পান: ডিহাইড্রেশন রক্তের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে। তাই পর্যাপ্ত পানি পান নিশ্চিত করতে হবে।
  • যোগাযোগ: রক্তস্বল্পতা বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে, নিকটবর্তী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত।

শেষ কথা

মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল বিষয়। এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে, জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ করে, এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করে। সঠিক যত্ন ও সচেতনতার মাধ্যমে রক্তের পরিমাণ ও মান সঠিক রাখা সম্ভব, যা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top