সার্বিয়া, বলকান উপদ্বীপের কেন্দ্রীয় স্থানে অবস্থিত, ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো, সার্বিয়া বর্তমানে বিদেশি কর্মীদের জন্য বিভিন্ন খাতে প্রচুর কাজের সুযোগ উন্মুক্ত করেছে। ফলে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য সার্বিয়া একটি নতুন সম্ভাবনাময় কর্মস্থল হয়ে উঠেছে। সার্বিয়ায় কাজ করতে আগ্রহী বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য এই নিবন্ধটি বিস্তারিত নির্দেশনা ও তথ্য প্রদান করবে।
সার্বিয়া একটি উদীয়মান অর্থনীতি, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। ইন্ডাস্ট্রি, নির্মাণকাজ, কৃষি, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, আইটি এবং মেকানিক্যাল খাতে প্রচুর কাজের চাহিদা রয়েছে। এর ফলে সার্বিয়া বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ এবং অদক্ষ উভয় ধরনের কর্মী নিয়োগ করছে। বাংলাদেশী কর্মীরা এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেদের জন্য ভালো আয় করতে পারেন।
সার্বিয়া বেতন কত
বর্তমানে সার্বিয়াতে একজন কর্মী গড়ে ৮ ঘণ্টার ডিউটি সম্পন্ন করলে ৫০০ থেকে ৬০০ ইউরো পর্যন্ত বেতন পেতে পারেন, যা সার্বিয়ান দিনারে প্রায় ৬৯,৬০০ থেকে ৭০,০০০ দিনার হয়। বাংলাদেশী টাকায় এই পরিমাণ প্রায় ৬০,০০০ থেকে ৬৫,০০০ টাকার মধ্যে। তবে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ কর্মীদের বেতন আরও বেশি হতে পারে। বিশেষ করে যেসব খাতে উচ্চ দক্ষতা প্রয়োজন যেমন ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ড্রাইভার ইত্যাদি, তাদের বেতন ৮০০ থেকে ১০০০ ইউরো বা তার বেশি হতে পারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ বেতন প্রায় ১ লক্ষ থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা।
আরও পড়ুনঃ সার্বিয়া ১ টাকা বাংলাদেশের কত টাকা
সার্বিয়ার সর্বনিম্ন বেতন ২০২৪
কোনো কাজের ধরণ, কর্মীর দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সার্বিয়াতে সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারিত হয়। সাধারণত সার্বিয়ার ন্যূনতম বেতন ৪০০ ইউরো থেকে ৫০০ ইউরোর মধ্যে হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকার সমান। কিছু খাতে যেমন নির্মাণকাজ বা কৃষি, ন্যূনতম বেতন এই সীমার মধ্যে থাকে। তবে উচ্চ দক্ষতার চাকরিতে যেমন আইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ম্যানেজমেন্ট পজিশনে বেতন অনেক বেশি হয়। তাই বাংলাদেশী কর্মীরা তাদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজ বেছে নিয়ে ভালো আয় করতে পারেন।
সার্বিয়াতে কোন কোন কাজের বেতন কত
সার্বিয়াতে বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বেতন কাঠামো রয়েছে। নিচে কিছু জনপ্রিয় কাজের বেতন তুলে ধরা হলো:
কাজের নাম | মাসিক বেতন (বাংলাদেশি টাকা) |
---|---|
কৃষি কাজ | ৬০,০০০ – ৯০,০০০ টাকা |
ইলেকট্রিশিয়ান | ৮০,০০০ – ১,০০,০০০ টাকা |
ডেলিভারি ম্যান | ৮০,০০০ – ১,২০,০০০ টাকা |
ড্রাইভিং | ৬০,০০০ – ৯০,০০০ টাকা |
কনস্ট্রাকশন শ্রমিক | ৬০,০০০ – ৯০,০০০ টাকা |
অটোমোবাইল সার্ভিস | ৮০,০০০ – ১,২০,০০০ টাকা |
প্লাম্বার | ৬৫,০০০ – ১,০০,০০০ টাকা |
শেফ | ৭০,০০০ – ৯০,০০০ টাকা |
রিসেপশনিস্ট | ৭৫,০০০ – ১,০০,০০০ টাকা |
কারখানার কাজ | ৭০,০০০ – ৯০,০০০ টাকা |
ওয়েটার | ৬০,০০০ – ১,০০,০০০ টাকা |
উল্লেখযোগ্য যে, অভিজ্ঞতা এবং কোম্পানির ধরনের উপর ভিত্তি করে বেতন সামান্য বাড়তে বা কমতে পারে।
সার্বিয়াতে কোন কোন খাতের চাহিদা বেশি
সার্বিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে বিদেশি শ্রমিকদের চাহিদা ব্যাপক। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাতের তালিকা দেয়া হলো যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভালো বেতন এবং সুযোগ রয়েছে:
- কৃষি খাত: সার্বিয়াতে কৃষিকাজে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। যারা কৃষিকাজে দক্ষ, তাদের জন্য সার্বিয়াতে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
- ইলেকট্রিশিয়ান এবং ইলেকট্রনিক্স: এই খাতে কাজের চাহিদা বেশ বেশি। যারা ইলেকট্রনিক ডিভাইস মেরামত বা ইলেকট্রিক্যাল কাজ করতে পারেন, তারা ভালো বেতন পেতে পারেন।
- মেকানিক্যাল ও ড্রাইভিং: সার্বিয়াতে যানবাহন পরিচালনা এবং যন্ত্রাংশ মেরামতের কাজে দক্ষ ব্যক্তিদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
- হোটেল ও রেস্তোরাঁ: হোটেল এবং রেস্তোরাঁ খাতেও প্রচুর কাজ পাওয়া যায়। এই খাতে শেফ, ওয়েটার এবং রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
- আইটি খাত: তথ্যপ্রযুক্তির চাহিদা বিশ্বব্যাপী বেড়ে চলেছে এবং সার্বিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। যারা প্রোগ্রামিং, নেটওয়ার্কিং বা সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য সার্বিয়া একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে।
সার্বিয়া যেতে কত টাকা লাগে
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সার্বিয়ায় কাজের জন্য যেতে কিছুটা খরচের সম্মুখীন হতে হয়। ভিসার ধরন, যাত্রা এবং দালালের ফি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে এই খরচ বিভিন্ন হতে পারে। ২০২৪ সালের জন্য প্রায় ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা নিয়ে প্রস্তুত থাকা উচিত। যদি সরকারিভাবে যাওয়া হয়, তবে খরচ কিছুটা কম হতে পারে, যা প্রায় ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে দালালের মাধ্যমে যাওয়ার ক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বেশি হতে পারে, যা প্রায় ৭ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ভিসার ধরন এবং যে কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করতে যাচ্ছেন তার উপর ভিত্তি করে এই খরচ নির্ধারিত হয়।
সার্বিয়ায় কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
সার্বিয়ায় যাওয়ার পূর্বে কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। প্রথমত, সার্বিয়ার কোনো কোম্পানির সাথে চুক্তি সই করার আগে বেতন এবং কাজের শর্তাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কাজের শর্ত অনুযায়ী ওয়ার্ক পারমিট এবং অন্যান্য আইনি নথিপত্র সঠিকভাবে নিশ্চিত করা উচিত। দ্বিতীয়ত, প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সরকার অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমেই ওয়ার্ক পারমিটের ব্যবস্থা করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শ্রমিকরা ভুয়া এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে কাজের জন্য যান এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। তাই প্রতিটি ধাপ সাবধানে সম্পন্ন করা উচিত।
সার্বিয়ায় বসবাস ও কাজের পরিবেশ
সার্বিয়া একটি শান্তিপূর্ণ দেশ এবং এখানকার জীবনযাত্রা বেশ সহজ ও আরামদায়ক। দেশটির জনসংখ্যা কম হওয়ায় ট্রাফিক জ্যাম বা অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ নেই। কাজের পরিবেশও অনেক সহনশীল এবং শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। তবে সার্বিয়ায় বসবাস করতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে। সার্বিয়ান ভাষা সার্বিয়ার প্রধান ভাষা, যদিও অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা প্রয়োজনীয় হতে পারে। তাই যারা এখানে কাজ করতে যাবেন, তাদের জন্য অন্তত প্রাথমিক স্তরের সার্বিয়ান ভাষা শিখে নেওয়া ভালো।
শেষ কথা
সার্বিয়া বর্তমানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। ভালো বেতন, কাজের সুযোগ এবং সহজ জীবনযাত্রার কারণে এটি অনেকের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তবে এখানে কাজ করতে গেলে কিছু ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সঠিক তথ্য এবং পরামর্শ নিয়ে কাজের জন্য প্রস্তুতি নিলে সার্বিয়াতে সফলভাবে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। সার্বিয়ার বর্তমান কর্মক্ষেত্র ও সুযোগ নিয়ে আপনার আরও বিস্তারিত প্রশ্ন বা পরামর্শের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট সরকারী বা বেসরকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করুন।