জমি ক্রয়ের পর, সেই জমি নিজের নামে তালিকাভুক্ত করতে হলে দলিল রেজিস্ট্রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একাধিক খরচ যেমন রেজিস্ট্রেশন ফি, স্টাম্প শুল্ক, স্থানীয় সরকার কর, উৎস কর ইত্যাদি প্রদান করতে হয়। প্রতিটি ধরণের জমির জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য খরচের পরিমাণ আলাদা হতে পারে, যা বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হয়। জমি ক্রয়ের পর এই খরচগুলো সঠিকভাবে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ক্রেতার মোট খরচের পরিমাণ নির্ধারণে সাহায্য করে।
এই প্রবন্ধে আমরা ২০২৪ সালের জমি রেজিস্ট্রেশন ফি, স্টাম্প শুল্ক, স্থানীয় কর এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের বিস্তারিত আলোচনা করব।
জমি রেজিস্ট্রি খরচ
জমি রেজিস্ট্রেশন হল একটি আইনগত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জমির মালিকানা সরকারিভাবে চিহ্নিত করা হয় এবং জমি মালিকানা একটি সরকারি রেকর্ড হিসেবে রেজিস্টার্ড হয়। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হলে রেজিস্ট্রেশন ফি প্রদান করতে হয়। দলিলের মূল্য অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন ফি নির্ধারিত হয় এবং এটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন হতে পারে।
রেজিস্ট্রেশন ফি নির্ধারণের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রি ফি ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা সহজ হলেও, সবসময় তা সঠিক আপডেট নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে, ম্যানুয়ালি হিসাব করা বেশি নিরাপদ এবং নির্ভুল।
১. জমি রেজিস্ট্রি খরচ বিভিন্ন ধরনের দলিলের জন্য
নিচে, জমির রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ খরচের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো:
সাফ কবলা বা বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রেশন ফি
যে দলিলের মাধ্যমে জমি, ফ্ল্যাট বা প্লট ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তাকে সাফ কবলা দলিল বলা হয়। এই দলিলের জন্য নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য খরচ নিম্নরূপ:
- রেজিস্ট্রেশন ফি: দলিলে লেখা জমির মূল্য অনুযায়ী ১%। যদি দলিলের মূল্য ২৪,০০০ টাকা বা তার কম হয়, তবে নগদ অর্থে এবং ২৪,০০০ টাকার বেশি হলে পে-অর্ডারের মাধ্যমে স্থানীয় সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের নির্দিষ্ট কোডে টাকা জমা দিতে হবে।
- স্টাম্প শুল্ক: দলিলে লিখিত জমির মূল্যের ১.৫০%, তবে সর্বোচ্চ সীমা ২ কোটি টাকা। স্টাম্পের খরচ সর্বোচ্চ ১,২০০ টাকা হতে পারে। অতিরিক্ত অর্থ পে-অর্ডারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে জমা দিতে হবে।
- স্থানীয় সরকার কর:
- সিটি কর্পোরেশন এবং ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অধীন জমির জন্য ২%
- অন্যান্য এলাকায় ৩%।
- উৎস কর (53H): বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকার জন্য উৎস করের হার পৃথক। যেমন, ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, মেহাখালী এলাকা ইত্যাদির জন্য ৪% হারে উৎস কর দিতে হবে, বা প্রতি কাঠার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা যেটি বেশী।
স্থাপনা বা ভবন সংক্রান্ত রেজিস্ট্রেশন
যদি জমির উপর কোন ভবন, ফ্ল্যাট বা স্ট্রাকচার থাকে, তবে সেই স্থাপনার জন্যও অতিরিক্ত কর দিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটার বা প্রতি কাঠা ভিত্তিতে নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট কর রয়েছে।
কিছু উদাহরণ
- গুলশান বা বনানী এলাকার জন্য: ঢাকাস্থ গুলশান, বনানী, মতিঝিল, মহাখালী এলাকায় জমি বা ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন করার ক্ষেত্রে ৪% কর অথবা প্রতি কাঠায় ১০,৮০,০০০ টাকা, যেটি বেশী।
- চট্টগ্রাম জেলার জন্য: আগ্রাবাদ, সিডিএ এভিনিউ এর জন্য প্রতি কাঠার ৩,৬০,০০০ টাকা অথবা ৪% রেট।
২. উৎস কর (53H) সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দিক
উৎস কর (53H) বিভিন্ন ধরনের জমি বা স্থাপনার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় আরোপিত একটি কর। ২০২৪ সালে, এই করটি কিছু বিশেষ এলাকার জন্য প্রযোজ্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত উৎস করের হার আলাদা হতে পারে, বিশেষত ঢাকায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকায়।
উদাহরণ
- গুলশান, বনানী এলাকায়: যদি জমির দলিল মূল্য ৯ কোটি টাকা হয়, তবে প্রতি কাঠার জন্য ১০,৮০,০০০ টাকা হারে ৫ কাঠা জমির জন্য ৫৪,০০,০০০ টাকা উৎস কর পরিশোধ করতে হবে।
- ধানমণ্ডি এলাকায়: যদি জমির মূল্য ২০,০০,০০০ টাকা হয়, তবে ৪% হারে ৮০,০০০ টাকা উৎস কর প্রদান করতে হবে।
৩. ভ্যাট (VAT) এবং ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন
ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (Value Added Tax) ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন হাউজিং সোসাইটির নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই ভ্যাট প্রদান করা বাধ্যতামূলক।
ফ্ল্যাটের ভ্যাট
- ১৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাট: দলিল মূল্য ২% ভ্যাট প্রযোজ্য।
- ১৬০১ বর্গফুটের বেশি: ফ্ল্যাটের দলিল মূল্য ৪% ভ্যাট প্রযোজ্য।
৪. সংশোধনীর পরিপত্র এবং ২০২৪ সালের নিয়মাবলী
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ২০১৪ সালের ০৯ জুলাই জারি করা পরিপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জমি এবং স্থাপনার রেজিস্ট্রেশন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য উৎস কর এবং অন্যান্য করের হার পুনরায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, জমির রেজিস্ট্রেশনের সময় ‘রাজউক’ বা ‘সিডিএ’ এর অধীনে থাকা এলাকার জমি বা স্থাপনার ক্ষেত্রে উৎস করের হার ভিন্ন হতে পারে। একইভাবে, অন্যান্য জেলা সদরের এলাকায় নির্ধারিত উৎস করের হারও পরিবর্তিত হতে পারে।
৫. রিয়েল এস্টেট ব্যবসার জন্য বিশেষ কর (53FF)
রিয়েল এস্টেট বা ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্লট বা জমি বিক্রয়ের জন্য আলাদা কর নিয়ম রয়েছে।
- ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ: ৫% উৎস কর।
- অন্য শহর ও গ্রামীণ এলাকায়: ৩% উৎস কর।
এছাড়া, ফ্ল্যাট এবং ভবন বিক্রির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ভ্যাট এবং উৎস করের কিছু পরিবর্তন রয়েছে, যা উল্লিখিত এলাকার উপর নির্ভরশীল।
৬. রেজিস্ট্রেশন খরচের উদাহরণ
এখানে দুইটি উদাহরণ দেওয়া হলো যেগুলো রেজিস্ট্রেশন খরচের হিসাব করতে সাহায্য করবে:
- উদাহরণ-১ঃ ঢাকাস্থ গুলশান এলাকায় ৫ কাঠা জমির দলিল মূল্য ৯ কোটি টাকা হলে, ৪% উৎস করের মাধ্যমে পরিশোধযোগ্য কর হবে ৫৪,০০,০০০ টাকা।
- উদাহরণ-২ঃ ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের দলিল মূল্য ৫৭,৫০,০০০ টাকা হলে, জমির জন্য প্রদেয় কর হবে ১,২০,০০০ টাকা এবং ফ্ল্যাটের জন্য ২,২৭,০০০ টাকা।
শেষ কথা
জমি রেজিস্ট্রেশন ফি এবং সংশ্লিষ্ট খরচগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা জমি ক্রেতাকে অবশ্যই জেনে নিতে হবে। একদিকে, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্টাম্প শুল্ক, স্থানীয় সরকার কর এবং উৎস কর ইত্যাদি খরচ জমির মালিকানা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, নিয়ম এবং হার সবসময় পরিবর্তিত হতে পারে, তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে সঠিক তথ্য গ্রহণ করা অপরিহার্য।
এছাড়া, যদি আপনি রিয়েল এস্টেট ব্যবসা বা ভবন নির্মাণে যুক্ত হন, তবে ভ্যাট এবং উৎস করের বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে। সবশেষে, জমি ক্রয় এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সঠিক রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য খরচ নির্ধারণ করতে ফি ক্যালকুলেটরের মাধ্যমে বা সরাসরি রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।