
জমি ক্রয়ের পর, সেই জমি নিজের নামে তালিকাভুক্ত করতে হলে দলিল রেজিস্ট্রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একাধিক খরচ যেমন রেজিস্ট্রেশন ফি, স্টাম্প শুল্ক, স্থানীয় সরকার কর, উৎস কর ইত্যাদি প্রদান করতে হয়। প্রতিটি ধরণের জমির জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য খরচের পরিমাণ আলাদা হতে পারে, যা বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হয়। জমি ক্রয়ের পর এই খরচগুলো সঠিকভাবে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ক্রেতার মোট খরচের পরিমাণ নির্ধারণে সাহায্য করে।
জমি রেজিস্ট্রি খরচ
সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন বা দলিল রেজিস্ট্রেশন বাংলাদেশের সম্পত্তি লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটি কেবলমাত্র আইনগত অধিকার সংরক্ষণের জন্য নয়, এটি সরকারের জন্য রাজস্ব আহরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই নিবন্ধে সাফ কবলা বা বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত সমস্ত ফি, শুল্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিশদে আলোচনা করা হয়েছে।
১। রেজিস্ট্রেশন ফি দলিলের লিখিত মূল্যের ১%
রেজিস্ট্রেশন ফি সম্পত্তির দলিলে উল্লেখিত মূল্যের ১% হারে নির্ধারিত। এটি সম্পত্তি ক্রয় বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রধান ফি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল জমা দেওয়ার পূর্বে এই ফি প্রদান করতে হয়।
২। স্ট্যাম্প শুল্ক দলিলের লিখিত মূল্যের ১.৫%
স্ট্যাম্প শুল্ক দলিলের মূল্যের উপর ১.৫% হারে প্রযোজ্য। এটি স্ট্যাম্প আইন, ১৮৯৯ এর আওতায় নির্ধারিত একটি শুল্ক, যা দলিল নিবন্ধনের সময় সরকারকে প্রদেয়। দলিল প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পও এই শুল্কের অংশ।
৩। স্থানীয় সরকার কর দলিলের লিখিত মূল্যের ৩% (অথবা ২%)
স্থানীয় সরকার কর দলিলের লিখিত মূল্যের উপর নির্ধারিত হয়। তবে এটি এলাকার ভিত্তিতে ভিন্ন হতে পারে:
- উপজেলা এলাকায়: ৩%।
- সিটি কর্পোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায়: ২%।
এই কর স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৪। উৎসে কর বা উৎসে আয়কর (53H)
উৎসে কর বা উৎসে আয়কর বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন হারে প্রযোজ্য। এটি দলিলের মূল্যের উপর নির্ধারিত একটি কর। বিভিন্ন স্থানের জন্য করের হার নিম্নরূপ:
ক) গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা
- ৬% কর।
খ) জেলা সদরের পৌরসভা
- ৬% কর।
গ) অন্যান্য পৌরসভা এলাকা
- ৪% কর।
ঘ) গ্রামীণ এলাকা
- ২% কর।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: রাজউক, সিডিএ বা গণপূর্ত অধীন এলাকাগুলোর করের হার পৃথকভাবে নির্ধারিত যা নিবন্ধের শেষভাগে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
৫। উৎসে কর (53FF) রিয়েল এস্টেট এবং ভূমি উন্নয়ন সংস্থা
রিয়েল এস্টেট বা ভূমি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক প্লট, ভবন, ফ্ল্যাট বা জমি বিক্রয় করার ক্ষেত্রে উৎসে কর নির্ধারিত হয়েছে। এটি এলাকা এবং সম্পত্তির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।
ক) প্লট বা জমি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে
- ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা: দলিল মূল্যের উপর ৫%।
- অন্যান্য এলাকা: দলিল মূল্যের উপর ৩%।
খ) ফ্ল্যাট বা ভবন বিক্রয়ের ক্ষেত্রে (বর্গমিটার ভিত্তিক হার)
ঢাকা জেলার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা
- আবাসিক: প্রতি বর্গমিটার ১,৬০০ টাকা।
- বাণিজ্যিক: প্রতি বর্গমিটার ৬,৫০০ টাকা।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্যান্য উন্নত এলাকা
- আবাসিক: প্রতি বর্গমিটার ১,৫০০ টাকা।
- বাণিজ্যিক: প্রতি বর্গমিটার ৫,০০০ টাকা।
অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন
- আবাসিক: প্রতি বর্গমিটার ৭০০ টাকা।
- বাণিজ্যিক: প্রতি বর্গমিটার ২,৫০০ টাকা।
অন্যান্য এলাকা
- আবাসিক: প্রতি বর্গমিটার ৩০০ টাকা।
- বাণিজ্যিক: প্রতি বর্গমিটার ১,২০০ টাকা।
৬। মূল্য সংযোজন কর (VAT) দলিলের উপর নির্ধারিত হার
ক) ভূমি উন্নয়ন সংস্থা বা রিয়েল এস্টেট কর্তৃক জমি বিক্রয়
- দলিলের মূল্যের উপর ২% ভ্যাট।
খ) ফ্ল্যাট বিক্রয় বা হস্তান্তর
- ১-১৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাটের জন্য: ২% ভ্যাট।
- ১৬০১ বর্গফুট বা তার বেশি ফ্ল্যাটের জন্য: ৪.৫% ভ্যাট।
- পুনঃরেজিস্ট্রেশনের জন্য: ২% ভ্যাট।
৭। ই ফি এবং অন্যান্য ফি
ই ফি
- ১০০ টাকা।
এন ফি
- প্রতি ৩০০ শব্দবিশিষ্ট পৃষ্ঠা বা অংশের জন্য ২৪ টাকা।
এনএন ফি (নকলনবিশ পারিশ্রমিক)
- প্রতি ৩০০ শব্দবিশিষ্ট পৃষ্ঠা বা অংশের জন্য ৩৬ টাকা।
৮। অন্যান্য রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত ফি ও প্রক্রিয়া
হলফনামা
- ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে প্রস্তুতকৃত হলফনামা দলিলের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
কোর্ট ফি
- ১০ টাকার কোর্ট ফি সম্পত্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত আবেদনপত্রে সংযুক্ত করতে হবে।
৯। ফিস পরিশোধের পদ্ধতি
রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য ফি স্থানীয় সোনালী ব্যাংকের নির্ধারিত কোডে জমা দিতে হয়। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কোড ও পদ্ধতি দেওয়া হলো:
- রেজিস্ট্রেশন ফি: কোড ১-২১৬১-০০০০-১৮২৬।
- স্ট্যাম্প শুল্ক: কোড ১-১১০১-০০২০-১৩১১।
- উৎসে কর (53H): কোড ১-১১৪১-০০০০-০১১১।
- উৎসে কর (53FF): কোড ১-১১৪১-০০০০-০১০১।
- ভ্যাট: কোড ১-১১৩৩-০০০০-০৩১১।
এনএন ফি জমা পদ্ধতি
- এটি সরাসরি রেজিস্ট্রি অফিসে নগদে জমা দিতে হবে।
১০। বিশেষ নির্দেশনা এবং শর্তাবলী
- ১০ লক্ষাধিক টাকার জমি বা সম্পত্তি বিক্রয়, লিজ বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক।
- পুনঃরেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সমস্ত শুল্ক পুনরায় পরিশোধ করতে হবে।
- দলিল সংক্রান্ত যেকোনো ভুল এড়াতে পেশাদার পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১১। রাজউক ও সিডিএ অধীন জমির করের হার
রাজউক এবং সিডিএ এলাকায় জমি বিক্রয় বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে নির্ধারিত করের হার বিভিন্ন। কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় করের হার ৮% পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, জমিতে কোনো স্থাপনা থাকলে অতিরিক্ত কর প্রযোজ্য।
শেষ কথা
সাফ কবলা বা বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রেশন একটি জটিল প্রক্রিয়া হলেও সঠিক নির্দেশনা অনুসরণ করলে এটি অনেক সহজ হয়। দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ফি ও শুল্ক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অপরিহার্য। সঠিকভাবে দলিল প্রস্তুত এবং নিবন্ধনের জন্য পেশাদার আইনজীবীর সহায়তা নেয়া উত্তম। এছাড়া, নির্ধারিত কর ও শুল্ক যথাসময়ে পরিশোধ করা আইনগত সমস্যা এড়াতে সহায়ক হবে।