এলার্জি শব্দটি শুনলেই অনেকের শরীরে শিহরণ জাগে। কারণ এটি এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করতে পারে। কিন্তু এলার্জি আসলে কি? সহজ কথায়, এলার্জি হল আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার একটি প্রতিক্রিয়া, যখন এটি নিরীহ বা ক্ষতিকর নয় এমন উপাদানের প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। এলার্জি সাধারণত তখনই হয় যখন IgE নামক অ্যান্টিবডির মাত্রা রক্তে বেড়ে যায়। এটি মূলত সাধারণ জীবাণু বা বস্তুর বিরুদ্ধে দেহকে অতিরিক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য করে, ফলে এলার্জির লক্ষণ প্রকাশ পায়। আজকের এই লেখায় আমরা এমন একটি সাধারণ কিন্তু খুবই গুরুতর সমস্যা নিয়ে কথা বলব, যা আমাদের চারপাশে প্রচুর দেখা যায় এবং মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। সমস্যাটি হলো এলার্জি, যা নানা রকমের রূপে এবং কারণের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রভাব ফেলে।
এলার্জির কারণসমূহ
এলার্জির পেছনে বিভিন্ন ধরনের উপাদান কাজ করে। সাধারণত এই উপাদানগুলোকে অ্যালার্জেন বলা হয়, যা মানুষের শরীরে এলার্জি তৈরি করে। কিছু অ্যালার্জেনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ধূলা এবং ধূলিকণা
- পরাগরেণু (পোলেন)
- পোষ্যপ্রাণীর লোম বা মল-মূত্র
- খাদ্য উপাদান যেমন: বাদাম, দুধ, মাছ ইত্যাদি
- ঔষধ: কিছু মানুষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় এলার্জি হয়।
- রাবার বা ল্যাটেক্স জাতীয় পণ্য।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের এলার্জি সমস্যায় ভুগছেন বলে ওয়ার্ল্ড এলার্জি অর্গানাইজেশন জার্নালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়। এই পরিসংখ্যানটি প্রতিদিনই বাড়ছে এবং বিশেষত শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে।
এলার্জির ধরনসমূহ
এলার্জি অনেক ধরনের হতে পারে এবং এর প্রতিটি ধরন ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে শরীরে প্রতিক্রিয়া জানায়। নিচে কিছু সাধারণ এলার্জির ধরন এবং তাদের লক্ষণ তুলে ধরা হলো:
১. ত্বকের এলার্জি (Skin Allergy)
ত্বকের ওপর প্রভাব ফেলে এমন যে কোন ধরনের এলার্জিকে ত্বকের এলার্জি বলা হয়। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন:
- বিষাক্ত গাছের সংস্পর্শ
- পশু-পাখির সংস্পর্শ
- অলংকার বা ধাতব বস্তু
লক্ষণঃ
ত্বকের এলার্জির প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে চুলকানি, লালচে দাগ, ফোস্কা বা চামড়ার শুষ্কতা। এ ধরনের এলার্জির ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের দুই তিন দিনের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করে এবং প্রায় দুই তিন সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। প্রাথমিক প্রতিকারের জন্য ঠান্ডা পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থানগুলো মুছে ফেলা যেতে পারে।
২. ল্যাটেক্স এলার্জি (Latex Allergy)
ল্যাটেক্স এলার্জি শব্দটি হয়তো অনেকের কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে, কিন্তু এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলার্জি। ল্যাটেক্স হলো রাবার গাছের রস, যা বিভিন্ন রাবার পণ্য যেমন গ্লাভস, বেলুন, কনডম ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।
লক্ষণঃ
ল্যাটেক্স এলার্জির ক্ষেত্রে রাবারজাতীয় উপাদানের সংস্পর্শে চুলকানি, ফুলে যাওয়া, লালচে হয়ে যাওয়া দেখা দেয়। মারাত্মক অবস্থায় এটি শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে পানি পড়া বা চোখ জ্বালাপোড়ার মতো লক্ষণও সৃষ্টি করতে পারে।
৩. পোষ্য এলার্জি (Pet Allergy)
অনেকেই ভুলভাবে মনে করেন যে পোষা প্রাণীর লোম থেকে এলার্জি হয়। তবে আসলে পোষা প্রাণীর লোমে থাকা ধূলা, লালা বা মল-মূত্র থেকে এলার্জি সৃষ্টি হয়। বিশেষত বিড়াল বা কুকুরের মত পোষা প্রাণী থেকে এই ধরনের অ্যালার্জি হতে পারে।
লক্ষণঃ
পোষ্য এলার্জির সাধারণ লক্ষণগুলো হলো হাঁচি, চোখে চুলকানি এবং শ্বাসকষ্ট।
৪. খাদ্য এলার্জি (Food Allergy)
খাদ্য এলার্জি হলো দেহের প্রতিরোধক ব্যবস্থা যখন নির্দিষ্ট খাদ্য উপাদানের প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া জানায়। কিছু সাধারণ খাদ্য উপাদান যা এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে তা হলো:
- বাদাম
- দুধ
- ডিম
- মাছ
লক্ষণঃ
খাদ্য এলার্জির মধ্যে হঠাৎ করেই শরীরে র্যাশ দেখা দেওয়া, পেট ব্যথা, বমি বা ডায়রিয়া হতে পারে। মারাত্মক অবস্থায় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এলার্জির চিকিৎসা ও প্রতিকার
এলার্জির চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ঔষধ পাওয়া যায়, এবং প্রত্যেক ধরনের এলার্জির জন্য নির্দিষ্ট ঔষধ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। নিম্নে বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া কিছু সাধারণ এলার্জি ঔষধের তালিকা এবং সেগুলোর ডোজ উল্লেখ করা হলো:
এলার্জির জন্য ব্যবহৃত ঔষধসমূহ:
- Rupatadine 10 mg (Rupa/Rupatrol/Duvent)
ডোজ: ০+০+১ (২৪ ঘন্টায় একবার) - Cetirizine 10 mg (Alatrol/Artizin/Cetizin)
ডোজ: ০+০+১ (২৪ ঘন্টায় একবার) - Chlorpheniramine 4mg (Histacin/Histal/Histagen)
ডোজ: ১+১+১ (সকালে ১ টি, দুপুরে ১ টি, রাতে ১ টি) - Fexofenadine 60mg, 120mg, 180mg (Fexo/Fenadine)
ডোজ: ০+১+০ (৬০ মিগ্রা হলে দিনে ২ বার, ১২০ মিগ্রা বা ১৮০ মিগ্রা হলে দিনে ১ বার) - Loratadine 10mg (Loratadine/Loratine/Pretin)
ডোজ: ০+০+১ (দৈনিক ১ টি)
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সাবধানতা
এলার্জির ঔষধ সাধারণত নিরাপদ হলেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। অ্যান্টিহিস্টামাইন জাতীয় ঔষধ যেমন Cetirizine বা Chlorpheniramine এর ক্ষেত্রে ক্লান্তি, মাথাব্যথা, ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ব্যবহারে ওজন বৃদ্ধি, চামড়ার ফুসকুড়ি এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো গুরুতর সমস্যা হতে পারে। তাই, কোন ঔষধ সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
এলার্জি প্রতিরোধের উপায়
এলার্জির সমস্যা এড়ানোর জন্য আমাদের অবশ্যই কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন:
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা: আমাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা জরুরি, যাতে ধুলা-বালি বা পরাগরেণু জমা না হয়।
- অ্যালার্জেন থেকে দূরে থাকা: যে সকল উপাদান থেকে এলার্জি হয়, তা চিহ্নিত করে সেগুলোর সংস্পর্শ এড়ানো।
- পোষ্যপ্রাণীর যত্ন: পোষা প্রাণীর শারীরিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা প্রয়োজন, যাতে অ্যালার্জেন জমা না হয়।
শেষ কথা
এলার্জি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি কমন সমস্যা হলেও এটি কখনো কখনো খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাই এলার্জি সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা হলে তা উপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। একসঙ্গে সঠিক ঔষধ সেবন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এলার্জি থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন, সুস্থ থাকুন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন!
এলার্জি ঔষধ সংক্রান্ত কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তরঃ
এটি নির্ভর করে আপনার এলার্জির ধরন এবং তীব্রতার উপর। সঠিক ঔষধ বেছে নেয়ার জন্য ডাক্তার আপনাকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেন।
এলার্জি ঔষধ দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থাপনা নেয়া উচিত।
হ্যাঁ, হতে পারে। তাই অন্য কোনো ঔষধ সেবন করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।