জাফরান এর দাম ২০২৪

জাফরান এর দাম

বিশ্বের মূল্যবান ও বিরলতম মসলার মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে জাফরান, যা ‘লাল স্বর্ণ’ নামে পরিচিত। এই মূল্যবান মসলাটি উৎপাদিত হয় মূলত তীব্র শীতের দেশে, যেখানে বেগুনি রঙের এক বিশেষ ধরনের ফুলের লাল গর্ভমুণ্ড শুকিয়ে সংগ্রহ করা হয়। প্রতি ১৫০টি ফুল থেকে মাত্র এক গ্রাম জাফরান পাওয়া যায়, যা বছরের একবারই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। জাফরান সংগ্রহের প্রতিটি ধাপই করা হয় হাতে, যা এর উচ্চ দামের প্রধান কারণ। আমাদের দেশে এই মসলাটি সুগন্ধি ও আকর্ষণীয় রঙের জন্য ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।

জাফরানের পরিচয় ও উৎপত্তিস্থান

জাফরান ক্রোকাস স্যাটিভাস (Crocus sativus) নামক উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত, যা লিলি পরিবারের সদস্য। বিভিন্ন অঞ্চলে জাফরান বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন কেশর, কুমকুম, সাফরান, ইসপাগনল ইত্যাদি। গ্রিসে জাফরানের প্রথম উৎপত্তি ঘটে বলে ধারণা করা হয়, তবে ইরান, স্পেন এবং ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলে এর চাষাবাদ ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। জাফরান ফুল থেকে ৩০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত মসলা সংগ্রহ করা সম্ভব, যা শুকানোর পর মাত্র ৭ মিলিগ্রাম হয়ে যায়। এক কেজি শুকনো জাফরান সংগ্রহ করতে ১ লক্ষ ৫০ হাজার ফুল প্রয়োজন হয়, যা এর মূল্য নির্ধারণে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে।

ইতিহাসের পাতায় জাফরান

প্রাচীন সভ্যতায় জাফরান ব্যবহার করা হতো রঙ ও ঔষধি হিসেবে। প্রায় ৫০ হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকের একটি গুহার দেয়ালে আঁকা ছবিতে বন্য জাফরান ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সুমেরীয়, অ্যাসিরিয়া, এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে জাফরান ফুলের বর্ণনা আছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো প্রাচীন গ্রিসের মিনোয়ান সভ্যতার শিল্পকর্ম, যা প্রায় ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বে সান্তোরিনি দ্বীপের ফ্রেস্কো “দ্য স্যাফ্রন গাদারার্স”-এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। বর্তমান যুগে জাফরান বিরিয়ানি, শরবত, মিষ্টি, এবং আরও বহু রন্ধনপ্রণালীতে ব্যবহৃত হয়, এবং এটি বিশেষভাবে সম্মানিত একটি মসলা হিসেবে পরিচিত।

জাফরান এর দাম

বাংলাদেশে জাফরানের চাহিদা সময়ের সাথে বেড়েছে, তবে সঠিকভাবে আমদানির কোনো নির্দিষ্ট উপায় নেই। ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজারে যেমন কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজার, এবং গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটে জাফরানের দাম ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায়। সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এক গ্রাম জাফরানের দাম ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যেখানে ইরান, স্পেন এবং ভারতের কাশ্মীরের জাফরান সর্বাধিক পরিচিত। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মূলত দুবাই থেকে আমদানিকৃত জাফরান বিক্রি করেন, তবে এদের মধ্যে কেউই সঠিক আমদানিকারকের তথ্য জানাতে পারেন না। এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা বৈধভাবে কেউ দেশে জাফরান আমদানি করে না। চোরাই পথে জাফরান আমদানি হওয়ায় এর দাম কিছুটা কম থাকে, নাহলে প্রতি কেজি জাফরানের পাইকারি দাম চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যেত।

বাজার বিশ্লেষণ

  • বিশ্ববাজার:
    • ২০২৩ সালের শেষের দিকে, বিশ্ববাজারে জাফরানের দাম প্রতি কেজি ৩,০০,০০০ – ৪,০০,০০০ টাকার মধ্যে এর মধ্যে ছিল।
    • ২০২৪ সালে, বিশ্ববাজারে জাফরানের দাম স্থিতিশীল থাকার ধারণা করা হচ্ছে যা প্রতি কেজি ৪,০০,০০০ – ৫,০০,০০০ টাকা।
  • বাংলাদেশের বাজার:
    • ২০২৩ সালের শেষের দিকে, বাংলাদেশের বাজারে জাফরানের দাম প্রতি গ্রাম ২০০ – ৩০০ টাকার এর মধ্যে ছিল।
    • ২০২৪ সালে, বাংলাদেশের বাজারে জাফরানের দাম বিশ্ববাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা প্রতি গ্রাম ২৫০ – ৩৫০ টাকা।

জাফরানের মান ও গ্রেডিং

জাফরানের গুণমান অনুযায়ী এটিকে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করা হয়, যা বাজারের মূল্যের উপর প্রভাব ফেলে। ইরানি জাফরানের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত গ্রেড হলো ‘অল রেড সুপার নেগিন’, এরপর যথাক্রমে ‘অল রেড নেগিন’, ‘অল রেড সারগল’, ‘ফিলামেন্টস গ্রেড-১’, ‘ফিলামেন্টস গ্রেড-২’, এবং আরও নিম্নমানের গ্রেডগুলো। ফিলামেন্টস গ্রেড-২ জাফরান, যার লাল এবং হলুদ মিশ্র রং রয়েছে, বাংলাদেশের বাজারে বেশি পাওয়া যায়।

জাফরান ও গর্ভকালীন স্বাস্থ্য মিথ বা বাস্তবতা

অনলাইনে গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষায় জাফরান খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিভিন্ন প্রচারণা দেখা যায়। অনেকের বিশ্বাস, গর্ভাবস্থায় জাফরান খেলে অনাগত সন্তানের গায়ের রঙ ফর্সা হয়। তবে, এ বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কর্মরত গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. ছাবিকুন নাহারের মতে, জাফরানের সাথে গর্ভকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি শুধুমাত্র একটি মসলা যা খাবারে সুগন্ধি ও রঞ্জক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জাফরানের স্বাস্থ্য উপকারিতা

জাফরানের প্রচলিত কিছু গুণাগুণ রয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জাফরান ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক, এটি হজমে সহায়তা করে, গ্যাস্ট্রিক এবং আলসার নিরাময়ে কার্যকরী, পেশির শক্তি বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশে সহায়ক, এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এছাড়া এটি ঘুমের সমস্যা দূরীকরণে সহায়ক এবং হতাশা ও অবসাদ দূর করতে কার্যকরী বলে বিবেচিত। তবে, মাত্রাতিরিক্ত জাফরান গ্রহণ করলে এর বিপরীত ফলাফল দেখা দিতে পারে, যা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।

আসল জাফরান চেনার উপায়

আসল জাফরান চিহ্নিত করার জন্য এর স্বাদ, গন্ধ এবং রঙকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আসল ইরানি জাফরানের গন্ধ মিষ্টি এবং তীব্র হয়, এবং এর স্বাদ কিছুটা তিতকুটে হয়। এছাড়াও, জাফরানকে পানিতে ভিজিয়ে দেখে আসল নকল পরীক্ষা করা যায়। আসল জাফরান ধীরে ধীরে রঙ ছাড়ে, যেখানে নকল জাফরান দ্রুত রঙ ছাড়ে এবং দণ্ড হলুদ বা সাদা হয়ে যায়।

বাংলাদেশে জাফরান চাষের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে জাফরান চাষের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে। মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার হায়দারের মতে, বাংলাদেশের আবহাওয়া জাফরান চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। তবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আ ফ ম জামাল উদ্দিন গ্রিন হাউজ পদ্ধতিতে সফলভাবে জাফরান চাষের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জাফরান চাষ করা সম্ভব এবং বছরে একাধিকবার ফলন পাওয়া যায়।

শেষ কথা

জাফরান, যা ‘লাল স্বর্ণ’ নামে পরিচিত, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও বিরল মসলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা বাড়লেও এর উচ্চ মূল্য ও দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এটি এখনও সীমিত মানুষের কাছে পৌঁছায়। যদিও দেশে জাফরান চাষের কিছু সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এর জন্য আরও গবেষণা এবং প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে। ভবিষ্যতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জাফরান যদি বাজারে আসে, তবে এর দাম এবং গুণমান নিয়ে আরও সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top